ছাত্রলীগ থেকে আ'লীগে পদ পেয়ে বেপরোয়া কয়রার বাহারুল

 প্রকাশ: ০২ ফেব্রুয়ারী ২০২৩, ০১:৫৯ অপরাহ্ন   |   জেলার খবর


নিজস্ব প্রতিবেদক: খুলনার কয়রা উপজেলার সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এস এম বাহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতিসহ নানা অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। অনুনোমোদিত ২টি হাসপাতাল ও শেখ রাসেল প্রতিবন্ধী স্কুল প্রতিষ্ঠা এবং শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্য, হিন্দুদের জমি দখল ও দেশ ছাড়তে হুমকি, লাইসেন্সবিহীন ক্ষুদ্র ঋণ সমিতির নামে সুদের রমরমা ব্যবসা পরিচালনা, ইউনিয়ন পরিষদে নামমাত্র প্রকল্পে লক্ষ লক্ষ টাকা লোপাট সহ মাদকাসক্ত ক্যাডার বাহিনী দিয়ে অধ্যক্ষ, সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, ও সাধারণ জনগণকে মারপিট, জিম্মি ও চাঁদা আদায়, জমি দখল ও টেন্ডারবাজি করে প্রচুর সম্পদের মালিক হয়েছেন।

জানা গেছে, ২০১৮ সালে ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে সরাসরি কয়রা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হওয়ার পর থেকে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন বাহরুল। ক্ষমতাসীন দলের পদ-পদবি কাজে লাগিয়ে হয়েছেন অঢেল সম্পদের মালিক। তবে তার পেটোয়া বাহিনীর ভয়ে মুখ খুলতে চান না ভুক্তভোগীরা।

এলাকাবাসী বলছে, সরকারি ব্রজলাল (বিএল) কলেজের ছাত্র থাকাকালীন ২০০৯ সালে বাহারুল ইসলাম কয়রা ছাত্রলীগের সভাপতি হয়। ছাত্রলীগের  সভাপতি হয়েই উপজেলার ৬৫টি মৎস্য ঘের দখল করেন। ওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হলে সশস্ত্র দলবল নিয়ে হামলা চালান কয়রা উপজেলা প্রেস ক্লাবে। সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারকে মেরে আহত করা হয়। ভয়ে তৎকালীন সময়ে কয়রার সাংবাদিকরা বাহারুল ইসলামের অপকর্মের খবর প্রকাশ থেকে বিরত থাকে। সেই থেকে বাহারুল যথেচ্ছা অপকর্মের মাধ্যমে অঢেল অবৈধ সম্পদের মালিক হন এবং কয়রা উপজেলাকে নিজের রাজ্য হিসেবে শোষণ শুরু করেন। শুরু করেন ভোট কেন্দ্র দখল, সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ শিকার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে খুলনা শহরে কোটি টাকার জমি ক্রয়, গুলি ছোড়া, হিন্দুদের জমি দখল, ক্ষুদ্র ঋণের নামে কোটি কোটি টাকার সুদের কারবার এবং পদকে ব্যবহার করে চাঁদাবাজি, অপকর্ম করে অর্থোপার্জন। বাহারুলের এসব অপকর্ম নিয়ে কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে প্রকাশ্যে মারধরের শিকার হতে হয়।

বাহারুল ও তার পেটোয়া বাহিনীর হাতে লাঞ্ছিত তনুশ্রী (ছদ্মনাম) বলেন, '২০০৯ সাল কয়রা ছাত্রলীগের সভাপতি হয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠে বাহারুল। তার সঙ্গী হিসেবে সর্বদা স্থানীয় উচ্ছৃঙ্খল ৩০ থেকে ৪০ জন যুবক থাকে। তাদের নিয়ে এসব অপকর্ম করে বেড়ান বাহারুল। ২০১৮ সালে কয়রা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হওয়ার পরে বাহারুলের ক্ষমতার কাছে কয়রার মানুষ জিম্মি হয়ে পড়ে। তার বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস কারও নেই।’

কয়রা উপজেলা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মোস্তফা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘২০০৯ সালে বাহারুল ইসলাম ছাত্রলীগের সভাপতি হয়ে প্রেস ক্লাবে হামলা করলে ২১ দিন ক্লাব বন্ধ রেখেছিলাম। স্থানীয় সংসদ সদস্য সোহরাব আলী সানাকে জানালেও তিনি সহযোগিতা করেনি। এমনকি মামলা করার সাহসও পায়নি।'

২০১৩ সালে উত্তর বেদকাশি কাছারি বাড়ি বটতলা বৃক্ষমেলায় পুলিশ ও বাহারুলের ছাত্রলীগের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। তৎকালীন মেলা কমিটির সভাপতি সরদার নুরুল ইসলাম বলেন, 'গুলির ঘটনায় মামলা হয়। বাহারুল ওই মামলার আসামি ছিলো। এটা নিজেদের দলীয় বিষয়। তাই আমরা মামলা তুলে নিয়েছি।’

২০১৪ সালে বাহারুলের মারপিটের শিকার হন সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও সাংবাদিক মাওলা বক্স। তিনি বলেন, ‘বাহারুল আমাকে মেরে রক্তাক্ত করে। তার ভয়ে পরে মামলা করতেও সাহস পাইনি। বাহারুল প্রচন্ড দুর্ধর্ষ। তার হাতে মার খায়নি, কয়রায় এমন মানুষ খুবই কম আছে।’

২০১৬ সালে বাহারুল মেরে রক্তাক্ত করে উপজেলার প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মতিউর রহমানকে। এবিষয়ে তার ছেলে মিজানুর রহমান বলেন, ‘২০১৬ সালে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে বাহারুলের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর পক্ষে আমার বাবা কাজ করেন। ভোটে হেরে গেলে বাহারুল আমার বাবাকে মারধর করে।'

২০২১ সালে কয়রা সদর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে বাহারুলের বিরুদ্ধে ভোটের দিন কেন্দ্রে মারপিট ও দখলের অভিযোগে সদর ইউনিয়নের নির্বাচন স্থগিত করা হয়। তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সাবেক চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘ভোটের দিন ৪নং কয়রা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাহারুলসহ তার ছেলেরা গিয়ে অনেককে মারধর করে। তখন ওই কেন্দ্রের ফল স্থগিত করে নির্বাচনী অফিস। ২ মাস পরে ওই কেন্দ্রে আবার ভোট হয়েছিল।’

পরে সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হয়ে বাহারুল উত্তর চক মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল মাওলানা মাসুদকে তুলে এনে কয়রা বাজার ছখিনা মার্কেটের ওপরে তার টর্চার সেলে মারপিট করে। এতে র‍্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়ে জেলও খেটেছেন আওয়ামী লীগের এই নেতা।

এবিষয়ে ওই অধ্যক্ষ বলেন, 'বাহারুলকে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ সভাপতি না করায় সে আমার থেকে ১ লাখ টাকা চাঁদা নেয়। প্রাণের ভয়ে টাকা দিয়েছি। তবুও সে আমাকে তুলে নিয়ে মারধর করেছে। বলেছে, অধ্যক্ষের দায়িত্ব ছেড়ে দিতে।'

কয়রা মহারাজপুরের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ-আল মাহমুদ বলেন, ‘বাহারুল কেন্দ্র দখল করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। চেয়ারম্যান হয়েই ৬ মাসের মধ্যে অন্তত ৫ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।'

অনুসন্ধানে ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হলে তাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ ছিল। টিনের ঘরে বাস করতো বাহারুল। বাবা ফজর আলী সানা আমিন হওয়ায় বিভিন্ন বৈধ-অবৈধ জমির খবর রাখতেন। বাহারুল দলকে ব্যবহার করে অবৈধভাবে জমি দখল করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। শেখ রাসেল প্রতিবন্ধী স্কুলে চাকরির প্রলোভনে  ৪০ জনের কাছ থেকে জনপ্রতি ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা নিয়ে কয়রা থানার সামনে নিজ নামে ৩ একর জমি কিনে অনুমোদনহীন শেখ রাসেল প্রতিবন্ধী স্কুলে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

কয়রা সদর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের হিন্দুদের ভিপি তালিকাভুক্ত ৪০ বিঘা জমি ডিসিআর কাটে বাহারুলের বাবা। পরে ওই জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে অসহায়-গরিবদের কাছে ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা প্লট আকারে বিক্রি করেন। আবার কয়রা সদরে হিন্দুদের জমি দখল করে ১৭টি দোকান তৈরি ও ভাড়া দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে বাহারুলের বিরুদ্ধে। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়রা স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণে লবণ পানির ঘের বন্ধের নির্দেশ দিলে বাহারুল নোনাপানি উত্তোলনের পাইপ ভেঙে দেয়। আবার রাতের আঁধারে তাদের থেকে ৫ লাখ টাকা চাঁদা নিয়ে নোনাপানি তুলে ঘের করার ব্যবস্থাও করে দেন। স্বাস্থ্যসেবার নামে ২টি অবৈধ লাইসেন্সবিহীন বহু তলা হাসপাতালের মালিক ও পরিচালক বাহারুল ইসলাম। কয়রা কপোতাক্ষ কলেজের সামনে ১৬ শতক জমির ওপর ৫ তলা ভবন নির্মাণাধীন এবং চড়েন ২৫ লাখ টাকা দামের গাড়িতে।

এবিষয়ে এসএম বাহারুল ইসলামের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করলেও তিনি বক্তব্য না দিয়ে এড়িয়ে যান। এমনকি তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরে একাধিক বার কল দিলেও ফোন রিসিভ করেননি বাহারুল। 

এদিকে দলীয় পদকে ব্যবহার করে নানাবিধ অপকর্ম করায় এস এম বাহারুল ইসলামকে নিয়ে বিব্রত আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। তবে ভয়ে কেউ অভিযোগ না দেওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আইনজীবী সুজিত অধিকারী বলেন, ‘বাহারুলের অনেক কর্মকাণ্ড ইতোমধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তাকে দল থেকে সমর্থন করব না। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হারুনুর রশীদ বলেন, ‘আমরা খুব তাড়াতাড়ি বাহারুলের বিষয়ে আলোচনায় বসব।’

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক বি. এম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘বাহারুলের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

জেলার খবর এর আরও খবর: