শরীয়তপুর সদর উপজেলার শৌলপাড়ায় অতিদরিদ্রদের প্রকল্প কর্মসূচিতে চলছে হরি লুট।

 প্রকাশ: ২৬ মে ২০২২, ০৬:০৬ অপরাহ্ন   |   জনদুর্ভোগ





মোঃ ফারুক হোসেন, জেলা প্রতিনিধি শরীয়তপুর : ২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় পর্যায়ের অতি দরিদ্রদের প্রকল্প কর্মসূচিতে (৪০ দিনের কর্মসূচি) শরীয়তপুর সদর উপজেলার শৌলপাড়া ইউনিয়নের তিনটি প্রকল্পে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র ফুটে উঠেছে। এ নিয়ে এলাকাবাসীর অভিযোগে চলছে চাপা ক্ষোভ। অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচিতে স্থানীয় ইউপি সদস্য দেলোয়ার হোসেন, হামেদ রাজ ও সংরক্ষিত মহিলা সদস্য মেরিয়া বেগমের যোগসাজশে তিনটি প্রকল্পের সভাপতিদের দেয়া মনগড়া নিজস্ব শ্রমিকদের নামের তালিকা করে, নামে মাত্র কাজ করে চলছে অনিয়ম ও দুর্নীতি। প্রকল্পের শ্রমজীবী অতিদরিদ্রদের তালিকায় রয়েছে ইউপি সদস্যদের মনোনীত সচ্ছল প্রতিনিধিদের নাম। এসব কর্মসূচিতে নাম মাত্র কাজ করে, শতভাগ কাজ ও শ্রমিক উপস্থিতি দেখিয়ে লুটে নেয়া হচ্ছে প্রকল্পের লাখ লাখ টাকা। এর ফলে ভেস্তে যাচ্ছে সরকারের উন্নয়ন, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।


শরিয়তপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসের প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) তথ্য মতে, সদর উপজেলার শৌলপাড়া ইউনিয়নে ২২-২৩ অর্থবছরের আওতায় দ্বিতীয় পর্যায়ে তিনটি ওয়ার্ডে অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান প্রকল্প (৪০ দিনের কর্মসূচি) ৭ মে থেকে শুরু হয়ে চলবে ২৩ জুন পর্যন্ত। কিন্তু কাজ ৭ মে থেকে শুরুর কথা থাকলেও তা শুরু করা হয় ৯ মে থেকে।


উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাদের তালিকা মতে, ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের কুন্দুরিয়া এলাকার  নুরু সৈয়ালের বাড়ি হইতে দুলাল সর্দারের বাড়ি অভিমুখে রাস্তা পুনঃ নির্মাণ কাজের ১৩ জন শ্রমিকের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ২ লক্ষ ১০ হাজার টাকা। কাজটির সভাপতি ইউপি সদস্য দেলোয়ার হোসেন।


৭ নং ওয়ার্ডের পশ্চিম সারেঙ্গা এলাকায় মজিদ রাজের বাড়ী হইতে সালাউদ্দিন সরদারের বাড়ি অভিমুখে রাস্তার পূর্ণ নির্মাণ কাজের ১৩ জন শ্রমিকের নির্মাণ ব্যয় বরাদ্দ হয় ২ লক্ষ ১০ হাজার টাকা। প্রকল্পটির সভাপতি ইউপি সদস্য হামেদ রাজ।


একই ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ড এলাকার কামরুল মাদবরের বাড়ী হইতে সেলিম খলিফার জমি অভিমুখে রাস্তাটির পূনঃ নির্মাণ কাজে ১৫ জন শ্রমিকের বরাদ্দকৃত ব্যয় ধরা হয় ২ লক্ষ ৪২ হাজার টাকা। প্রকল্পটির সভাপতি সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্য মেরিয়া বেগম।


এলাকাবাসীর একাধিক অভিযোগের ভিত্তিতে গত সোমবার (১৭ মে) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সদস্য দেলোয়ার হোসেনের ৬ নং ওয়ার্ডের কাজে ১৩ জন শ্রমিকের স্থানে ৫ জন শ্রমিক কাজ করছে।


সদস্য হামেদ রাজের ৭ নং ওয়ার্ডের কাজে ১৩ জন শ্রমিককে স্থানে কাজ করছে ৫ জন শ্রমিক।


একই ভাবে সদস্য মেরিয়া বেগমের ৯ নং ওয়ার্ডে বেলা ১২টা ১৫ মিনিটে প্রকল্প স্থানে গিয়ে একজন শ্রমিক ও পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয় কয়েকজন জানান ৫ জন শ্রমিক কাজ করেছিল। তারা আরও এক ঘণ্টা আগে চলে গিয়েছে।


অধিকতর যাচাইয়ের জন্য গত রবিবার (২২ মে) সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে তিনটি প্রকল্পেই পুনরায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ৬ নং ওয়ার্ডের দেলোয়ার হোসেনের প্রকল্পে কোন শ্রমিক কাজে করছে না। ৭ নং ওয়ার্ডের হামেদ রাজের প্রকল্পে  শ্রমিক পাওয়া যায় ৫ জন, এবং ৯ নং ওয়ার্ডের মেরিয়া বেগমের প্রকল্পের কাজে শ্রমিক পাওয়া যায় ৫ জন। 


তিনটি প্রকল্পের কাজে মোট ৪১ জন শ্রমিক থাকার কথা থাকলেও, কাজ করছে ১৫ জন শ্রমিককে। কখনোই ৪১ শ্রমিকের উপস্থিতি পাওয়া যায় না। তাও আবার মাঝেমধ্যে কোন প্রকল্পে একজন শ্রমিক ও থাকেনা। কিন্তু প্রতিদিনই হাজিরায় শতভাগ শ্রমিক দেখানো হয়ে থাকে। 


নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কয়েকজন জানান, মেম্বারদের এসব কাজের অনিয়মের কথা বললে আমাদের উপর অত্যাচার হবে। এমনিতেই আমাদের রাস্তা গুলোর বেহাল অবস্থা, তাই যতটুকু করছে তাইতো আমাদের জন্য অনেক। তিনটি কাজে ৬ লক্ষ ৬২ হাজার টাকা বরাদ্দ হয়েছে। কিন্তু যে অল্প সংখ্যক শ্রমিক দিয়ে নিম্ন মানের কাজ হচ্ছে, তাতে তিনটি কাজে ১ লক্ষ টাকা ব্যয় হবে কিনা সন্দেহ। সরকার এসব প্রকল্পে রাস্তাঘাট উন্নয়নের জন্য কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে থাকলেও, স্থানীয় প্রতিনিধিরা তা সঠিকভাবে ব্যয় না করায়, আমরা বঞ্চিত হচ্ছি উন্নয়ন থেকে। এসব নামে মাত্র কাজ না করাই ভালো।


শ্রমিক সংখ্যা কম ও নিম্নমানের কাজের বিষয়ে ৯ নং প্রকল্প কাজের সভাপতি ইউপি সদস্য মেরিয়া বেগমের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও, তিনি ফোন রিসিভ করেননি।


তবে মেরিয়া বেগমের পক্ষে তার স্বামী মনির হোসেন, সদস্য দেলোয়ার হোসেন ও হামেদ রাজ জানান, এসব প্রকল্পের কাজ এভাবেই হয়ে থাকে। আপনার নিউজ করতে মনে চায় নিউজ করে দিন। যা মনে চায় লিখে দিন। কোন সমস্যা নেই। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) সহ সকলেই অবগত আছে। 


শৌলপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান খান ভাষানী বলেন, প্রতিটি প্রকল্পের কাজের সভাপতি স্থানীয় ইউপি সদস্যরা। তবে স্থানীয়ভাবে কয়েকজনের কাছে কাজের অনিয়মের কথা শুনেছি, আপনাদের কাছেও শুনলাম। এসব কাজের দায়দায়িত্ব প্রকল্প সভাপতিদের। তারপরও সরেজমিনে গিয়ে খোঁজ নেব, যদি কোনো অনিয়ম পাওয়া যায়, তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবগত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলব।


সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) নজরুল ইসলাম জানান, আমাদের জনবল সংকটের কারণে প্রতিদিন প্রকল্প গুলো পরিদর্শন করা সম্ভব হয় না। তবে মাঝেমধ্যে পরিদর্শনে যাওয়া হয়। যেসব প্রকল্পে দুর্নীতি কিংবা অনিয়মের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যাবে, তাদের টাকা কর্তন করা হবে। প্রকল্পের কাজে অনিয়মের কোন ছাড় দেয়া হবে না।


সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মনদীপ ঘরাই বলেন, কর্মসূচির অনিয়মের বিষয়ে নির্বাহী কর্মকর্তা কোন বিষয়ে অবগত নয়। যদি কোন প্রকল্পের কাজে অনিয়ম হয়ে থাকে এবং প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের বিল আটকে দেয়া সহ প্রয়োজনীয় সমস্ত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।