৩০০ টাকার বালতি ১ হাজার ৮৯০ টাকায় কিনেছেন পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে।

 প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০১:১৯ অপরাহ্ন   |   অপরাধ


লিয়াকত, রাজশাহী ব্যুরোঃ  

 রুপার প্রলেপ দেওয়া বালতি নয়, তার পরেও একটি প্লাস্টিকের বালতির দাম ধরা হয়েছে এক হাজার ৮৯০ টাকা। সোনার প্রলেপ দেওয়া কোনো তালা নয়, তার পরেও এটির দাম ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার ৫৫০ টাকা।  আর ফুঁ দেওয়া সাধারণ যে বাঁশি, সেটার মুল্য ধরা হয়েছে ৪১৫ টাকা। এমন সব মাথা ঘুরানো মুল্য নির্ধারণ করা হয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের কেনাকাটায়। মুল্য নির্ধারণ দেখে যে কারো মনে হতে পারে, রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের কর্তারা তালা, বালতি' কিংবা বাঁশি নয়, কিনেছেন ‘আলাদিনের চেরাগ'।


২০১৮-১৯ অর্থবছরে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের বিভিন্ন স্টেশনের মালপত্র কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৩৩ গুণ পর্যন্ত বেশি দামে কেনা হয়েছে। এ বছরের শুরুর দিকে পরিবহন অডিট অধিদপ্তর রেলওয়ের বিভিন্ন মাল কেনাকাটাসহ অন্যান্য বিষয়ে নিরীক্ষা করে। তার মধ্যে পরিবহন অডিট অধিদপ্তর থেকে রেল মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে ইতিমধ্যে নিরীক্ষা প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে।


নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশ করে অতিরিক্ত দামে মালপত্র কেনা হয়েছে। এতে সরকারের মোট ক্ষতির পরিমাণ ১৬ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা। সরবরাহকৃত মালামালের মধ্যে রয়েছে ভিজিটিং চেয়ার, মাইল স্টিলের চেয়ার, স্টিলের আলমারি, ফাইল কেবিনেট, সেক্রেটারি টেবিল, কাঠের চেয়ার, রিভলবিং চেয়ার, ক্রোকারিজ মাল, সোফা সেট, প্রতিবন্ধী হুইলচেয়ার ইত্যাদি।


এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন স্টেশনে লেভেলক্রসিং গেটে ব্যবহারের জন্য তালা, বালতি, ঝাণ্ডা ও বাঁশি কেনা হয়েছে। এর মধ্যে তালা কেনা হয়েছে প্রকৃত বাজারদরের চেয়ে সর্বোচ্চ ৩৩ গুণ বেশি দামে। এখানে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ২৬ লাখ ৭৩ হাজার ৮৫০ টাকা। ১৫০ টাকা দামের তালা কেনা হয়েছে পাঁচ হাজার ৫৫০ টাকায়, প্রতিটি ৩০০ টাকা দামের বালতি এক হাজার ৮৯০ টাকায়, ৫০ টাকা দামের বাঁশি ৪১৫ টাকায় এবং ১৬০ টাকার ঝাণ্ডা কেনা হয়েছে এক হাজার ৪৪০ টাকায়।


আরও কেনা হয়েছে পেডাল ডাস্টবিন। পেডাল ডাস্টবিনের গায়ে প্রতিটির দাম লেখা আছে ৬০০ টাকা। ৩০ শতাংশ ভ্যাটসহ তা হবে ৭৮০ টাকা। অথচ কেনা হয়েছে প্রতিটি সর্বনিম্ন আট হাজার ৯৯৫ টাকা দরে। এতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৪৫ লাখ ৬০ হাজার ৭৫০ টাকা।


ভিআইপি পর্দা কেনা হয়েছে ১১ গুণ বেশি দামে। এক হাজার ২০০ টাকা দামের পর্দা কেনা হয়েছে প্রায় ১৮ হাজার টাকায়। বিভিন্ন রেলওয়ে স্টেশনের ওয়েটিং রুমে ব্যবহারের জন্য এসব পর্দা কেনা হয়। যাচাইকালে অডিট কমিটি জানতে পারে, ভিআইপি পর্দা কেনা হলেও তা রেজিস্টারে হিসাব রাখা হয়নি । বাজার যাচাইও করা হয়নি। কাল্পনিকভাবে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। ভিআইপি পর্দা কিনে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৪৪ লাখ ৪১ হাজার ৩৩০ টাকা।


এদিকে ১১ গুণ বেশি দামে কেনা হয়েছে লাগেজ ফিতাসহ ৭৫ হাজার ওয়াগন কার্ড (ওপিটি কার্ড-২১৬)। গত বছরের ২০ জানুয়ারি ৫০ হাজার কার্ড কেনা হয়েছে ৪৯.৩৮ টাকা দরে। পরে একই বছরের ১৭ জুন ২৫ হাজার কার্ড কেনা হয়েছে ১৯.৯৯ টাকা দরে। আলাদাভাবে একই দ্রব্য কেনার দরেও রয়েছে বিস্তর ফারাক। অডিট কমিটি বাজার যাচাই করে জানতে পারে, ওই কার্ডের প্রকৃত দাম ৩.৪০ টাকা। এতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ২৬ লাখ ৩৭ হাজার ২৫০ টাকা।


প্রকৃত বাজারদরের চেয়ে তিন গুণ বেশি দামে কেনা হয়েছে ভিজিটিং চেয়ার। ৩০ শতাংশ ভ্যাটসহ ওই চেয়ারের প্রতিটির প্রকৃত বাজারদর ছয় হাজার ৮২৫ টাকা, কিন্তু পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল ২০টি ভিজিটিং চেয়ারের প্রতিটি কিনেছে ১৬ হাজার ৮৭০ টাকা দরে। এতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে দুই লাখ ৯০০ টাকা। ২০১৯ সালের ১৭ জুন দ্বিগুণ দামে কেনা হয় ২২০টি লাগেজ ট্রলি, যার প্রতিটির বাজারদর তিন হাজার ৩০০ টাকা, কিন্তু কেনা হয়েছে প্রতিটি ১০ হাজার ২৯৮ টাকা দরে। এতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১৩ লাখ ২১ হাজার ৭৬০ টাকা।


৫০০টি উন্নত মানের পাপোশ কেনা হয়েছে চার গুণ বেশি দামে। প্রতিটি পাপোশের প্রকৃত বাজারদর ৩০০ টাকা হলেও কেনা হয়েছে এক হাজার ৪৭৬ টাকা দরে। এতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে পাঁচ লাখ ৪৩ হাজার টাকা।


তোশিবা ব্র্যান্ডের একটি ফটোকপিয়ারের বাজারদর ভ্যাটসহ এক লাখ ১১ হাজার ২৮০ টাকা হলেও তা কেনা হয়েছে চার লাখ ৬৩ হাজার ২০ টাকায়। চার গুণ উচ্চমূল্যে ফটোকপিয়ারটি কেনার কারণে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তিন লাখ ৫১ হাজার ৭৪০ টাকা।


৩২ সেট তিন সিটের গদিযুক্ত স্টিল ফ্রেমের চেয়ার কেনা হয়েছে ওই অর্থবছরে। এসব চেয়ার বাজারদরের চেয়ে চার গুণ বেশি দামে কেনা হয়েছে। এতে ক্ষতি হয়েছে ১৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১৬ টাকা। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে তিন সিটের চেয়ার কেনা হলেও সরবরাহ করা হয়েছে দুই সিটের চেয়ার।


বাজারদরের চেয়ে দ্বিগুণ দামে কেনা হয়েছে ৬২০টি লেদার ক্যাশ ব্যাগ। এগুলো গত বছরের বিভিন্ন সময়ে কখনো কেনা হয়েছে আট হাজার ৪৯৫ টাকা দরে আবার কখনো পাঁচ হাজার ৪৯৯ টাকা দরে। একই ব্যাগ বিভিন্ন দামে কেনায় আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ৬৪০ টাকা।


২০১৯ সালের ১৪ মার্চ ১০০টি উন্নত মানের ফার্স্ট এইড বক্স কেনা হয়। প্রতিটি বক্স কেনা হয়েছে ছয় হাজার ৪৯৬ টাকা দরে। ওই বক্সের প্রতিটির বাজারদর এক হাজার ৪৫০ টাকা। এতে ক্ষতি হয়েছে চার লাখ ৬১ হাজার ১০০ টাকা।


তিন গুণ বেশি দামে কেনা হয়েছে ২০০টি ফায়ার বাকেট এবং ৮০টি ফায়ার বাকেট স্ট্যান্ড। অডিট প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে বাজারদরের চেয়ে তিন গুণ বেশি দামে কেনার কারণে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ছয় লাখ ৫৮ হাজার ৬৮০ টাকা।


এদিকে তিন গুণ বেশি দামে কেনা হয়েছে ১৫০টি ইলেকট্রিক দেয়ালঘড়ি। প্রতিটি ঘড়ি কেনা হয়েছে চার হাজার ৪৯৮ টাকায়। প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি ঘড়ির দাম এক হাজার ৫০০ টাকা। এখানে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তিন লাখ ৮২ হাজার ২০০ টাকা।


হুইল ডাস্টবিন কেনা হয়েছে দুই গুণ বেশি দাম দিয়ে। গত বছর দুই দফায় কেনা হয়েছে ১৫৫টি হুইল ডাস্টবিন। এর মধ্যে ৩০টির ক্রয়মূল্য ছিল প্রতিটি ১২ হাজার ৯৭৬ টাকা এবং ১২৫টির কেনা দাম ছিল প্রতিটি ৯ হাজার

কিন্তু নিরীক্ষা কমিটি বাজার যাচাই করে জানতে পারে, বাজারে হুইল ডাস্টবিন প্রতিটির দাম ৩০ শতাংশ ভ্যাটসহ ছয় হাজার ১১০ টাকা। উচ্চমূল্যে কেনার কারণে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ছয় লাখ ৭৯ হাজার পাঁচ টাকা।


দ্বিগুণ বেশি দামে কেনা হয়েছে ১০০টি উন্নত মানের কাঠের অভিযোগ বাক্স। প্রতিটি তিন হাজার ৭৪৮ টাকা দরে, কিন্তু বাজারে প্রতিটির দাম ভ্যাটসহ এক হাজার ৫০৮ টাকা। এতে ক্ষতি হয়েছে দুই লাখ ২৪ হাজার টাকা।


বাজারদরের চেয়ে তিন গুণ বেশি দামে কেনা হয়েছে অটবি প্লাস্টিক চেয়ার। এতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১৭ লাখ ৪৪ হাজার ২০০ টাকা। প্রতি সেট চেয়ারের বাজারদর ১১ হাজার ২২০ টাকা হলেও কেনা হয়েছে ৪৯ হাজার ৪৭০ টাকায়। এদিকে বাজারদরের চেয়ে দ্বিগুণ দামে কেনা হয়েছে ৪০টি উন্নত মানের লোহার ফিক্সড ক্যাশ সেভ। বাজারে দাম ৩০ হাজার ৮০০ টাকা হলেও প্রতিটি কেনা হয়েছে ৬০ হাজার ৪৯০ টাকা দরে। এতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১৩ লাখ ২৯ হাজার ৪৭৫ টাকা। পরিবহন অডিট অধিদপ্তর যে নিরীক্ষা করেছে তাতে প্রায় প্রতিটি পণ্যের জন্য আলাদা প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। বেশির ভাগ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার কেনাকাটার প্রয়োজনীয় কাজ সম্পাদন করেছেন।


পাকশীর বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক মো. শাহীদুল ইসলামও বলেছেন, ‘আমরা কেনাকাটায় সম্পৃক্ত থাকি না। চাহিদা দিয়ে থাকি। কেনাকাটা করে থাকে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজারের দপ্তর।


এসব বিষয়ে, রাজশাহী পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার মোহাম্মদ আহসান উল্লাহ ভুঁঞা বলেন, ‘অডিট হয়েছে শুনেছি। অডিট প্রতিবেদনের একটি কপি আমার কাছে আসার কথা। এখনো আসেনি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই দায়িত্বে আমি ছিলাম না। ২০২০ সালে আমি এখানে এসেছি। কেনাকাটা যা হয়েছে তা আমার আসার আগে। তার পরও অডিট প্রতিবেদন পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় যা করার আমি করব।


২০১৮-১৯ অর্থবছরে রাজশাহীর পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন এ এম এম শাহনেওয়াজ। তিনি এখন চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট (পূর্ব) পদে চট্টগ্রামে কর্মরত। তাঁর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘আমি ওই সময়ে দায়িত্বে থাকলেও শুধু কেনাকাটার চাহিদা দিয়েছি, কিন্তু ওই কেনাকাটা করেছেন রেলের স্টোর কন্ট্রোলার। তিনি এসব কেনাকাটার সঙ্গে জড়িত নন বলে দাবি করেন। বাড়তি দামে স্টেশনের বিভিন্ন মাল কেনার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সেলিম রেজা বলেন, ‘বিষয়টি আমার নলেজে নেই। আমি সবেমাত্র দায়িত্ব ভার বুঝে নিয়েছি এ বিষয়টি আমি জানি না। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে বিষয়টি অবশ্যয় তদন্ত করে দেখা হবে।

অপরাধ এর আরও খবর: