মহামারী কলেরা মারাত্নক ছিলো নাকি মহামারী করোনা মারাত্নক?

(এহছান খান পাঠান):
মহামারী কলেরা সম্পর্কে যাদের পড়াশোনা আছে তারা জেনে থাকবেন কলেরা একটি সংক্রামক রোগ যার প্রধান উপসর্গ মারাত্মক উদরাময়, মুহূর্মহু প্রচুর জলের মত পাতলা পায়খানা, সঙ্গে পেটব্যথা, পানি শুন্যতায় শারীরিক দৌর্বল্য এবং চিকিৎসা না হলে শেষপর্যন্ত দেহে পানি শুন্যতার ফলে মৃত্যু। জোরালো সংক্রমণ ও টক্সিনের বিষক্রিয়া হলে কলেরার প্রাণঘাতী ক্রিয়ায় ১ ঘণ্টায় একজন সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষের রক্তচাপ অস্বাভাবিক কমে যেতো ও ২-৩ ঘণ্টায় মৃত্যু পর্যন্ত হতো। সাধারণ মাঝারি মাপের সংক্রমণে ৪-১২ ঘণ্টায় শক (অর্থাৎ নিম্ন রক্ত চাপ ইত্যাদি কারণে দেহের সমস্ত অংশে রক্ত সরবরাহের অভাব) এবংপরবর্তী দেড় দিন বা কয়েক দিনের মধ্যে মৃত্যু হতো। তার মানে করোনা সুস্থ্য হতে সময় দিলেও কলেরা সময় দিতোনা। আগেরকালে কলেরায় আক্রান্ত হলে বেচে ফেরার সম্ভাবনা ছিল শুন্যের কোটায়। কলেরায় মৃত্যু শুরু হলে বাড়ির পর বাড়ি, পাড়ার পর পাড়া এমনকি গ্রামের পর গ্রামে শতশত মানুষ মারা যাওয়ার হাজারো ঘটনা রয়েছে।
১৯২০ সালের জুন মাসে ২ ঘন্টায় মারা গিয়েছিলো আমার দাদাজান সুফি আব্দুল খালেক খান পাঠান রহ. (ফরিদপুরের সুফি সাহেব) এর পরিবারের ১৩ জন সদস্য। দাদারা ২ ভাই কলকাতায় থাকায় আক্রান্ত হননি। ২০২০ এর জুনে স্মরন করছি সেই ১৩ জনকে। সাথে স্মরণ করছি আমার দাদাজান সুফি আব্দুল খালেক খান পাঠান রহ. (ফরিদপুরের সুফি সাহেব)কে। আরো স্মরন করছি কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া আমার দাদার অবিবাহিত ভাই, মোতাহার হোসেন খান পাঠান (এফআরসিএস)কে, যিনি ১৯২৯ সালে ডাক্তারি পড়তে বিলেত (লন্ডন, যুক্তরাজ্য) যান। যুক্তরাজ্যে ৫ বছর পড়াশোনা ফেলো অব দ্যা রয়্যাল কলেজ অব সার্জন (এফআরসিএস) অর্জন করে ১৯৩৪ সালে দেশে ফিরে আসেন। দুর্ভাগ্য এইযে, বিলেত ফেরত এফআরসিএস ডাক্তার হলেও তিনি এদেশের মানুষের সেবা করার আগেই জলাতঙ্ক রোগে মারা যান।
এক নজরে সুফি আব্দুল খালেক খান পাঠান রহ. (ফরিদপুরের সুফি সাহেব)
সুফি আব্দুল খালেক খান পাঠান ১৯০৭ সালে তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহাকুমার (বর্তমানে গোপালগঞ্জ জেলা ) মুকসুদপুর উপজেলার বেজড়া গ্রামে সম্ভান্ত পাঠান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সেসময়ে মুকসুদপুর উপজেলায় তেমন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিলো না। আব্দুল খালেক খান পাঠান তার সহোদর মোতাহার হোসেন খান পাঠানকে সাথে নিয়ে মুকসুদপুর উপজেলার ইন্দুহাটি গ্রামের হলধর মজুমদারদের পাঠশালায় শিক্ষাগ্রহণ করতে থাকেন। ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রমেশ চন্দ্র্র মজুমদার এবং মোতাহার হোসেন খান পাঠান একই শ্রেনীতেই ছিলেন। শ্রেনীতে প্রথম হওয়া নিয়ে রমেশ চন্দ্র্র মজুমদার এবং মোতাহার হোসেন খান পাঠান তুমুল প্রতিদ্বন্ধিতা ছিলো। পরবর্তীতে রমেশ চন্দ্র্র মজুমদার এর বাবা হলধর মজুমদার মোতাহার হোসেন খান পাঠানকে তাদের পাঠশালায় পড়তে বারণ করলে পাঠশালার পন্ডিত (নাম খেয়াল নেই) কলকাতার বেকার হোস্টেলের তত্ত্বাবধায়ককে মোতাহার হোসেন খান পাঠানকে পড়াশোনার সুযোগ করে দিতে চিঠি দেন। চিঠি সহ আব্দুল খালেক খান পাঠান তার সহোদর মোতাহার হোসেন খান পাঠানকে সাথে নিয়ে কলকাতায় যান। ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ মেটাতে নিজের পড়াশোনা বাদ দিয়ে ব্যবসায় নামেন এবং কলকাতা সিটি করপোরেশন এ ঠিকাদার হিসেবে কাজ শুরু করেন।
মোতাহার হোসেন খান পাঠান এন্ট্রান্স পাস করে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ (বর্তমান এইচএসসি’র সমমান) পাশ করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়া অবস্থায় ১৯২০ সালে কলেরা মহামারীতে আব্দুল খালেক খান পাঠান এর পরিবারের ১৩ সদস্য ২ঘন্টার মধ্যে একই দিনে মারা যান। মহামারী কলেরায় আব্দুল খালেক খান পাঠান তার সহোদর মোতাহার হোসেন খান পাঠান কোলকাতায় থাকায় মহামারী থেকে রক্ষা পান।
মহামারী কলেরায় সব স্বজন হারিয়ে আব্দুল খালেক খান পাঠান তার ভাই মোতাহার হোসেন খান পাঠানকে ডাক্তার বানাবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেন। ১৯২৯ সালে মোতাহার হোসেন খান পাঠান ডাক্তারি পড়তে বিলেত (লন্ডন, যুক্তরাজ্য) যান। যুক্তরাজ্যে ৫ বছর পড়াশোনা ফেলো অব দ্যা রয়্যাল কলেজ অব সার্জন (এফআরসিএস) অর্জন করে দেশে ফিরেন ১৯৩৪ সালে। ভাগ্যের পরিহাস এইযে, দেশে ফেরার পরদিনই পাগলা কুুকুরে তাকে কামড়ে দেয়। প্রথমে গুরুত্ব না দিলেও পরবর্তীতে জলাতঙ্ক রোগে তিনি মারা যান।
কলকাতা সিটি করপোরেশন এর প্রথম শ্রেনীর ঠিকাদার ছিলেন আব্দুল খালেক খান পাঠান। অন্যদিকে ভাইকে বিলেতে পাঠিয়ে বিলেতে রপ্তানি ব্যবসায় নাম লিখিয়েছিলেন। কলকাতা থেকে কাছিমের যত চালান বিলেতে যেত সেটি সবই নিয়ন্ত্রন করতেন আব্দুল খালেক খান পাঠান।
কলেরায় পরিবারের সবাইকে হারানোর পর ডাক্তার ভাইকে হারিয়ে আব্দুল খালেক খান পাঠান মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েন। তাছাড়া দুই ভাইয়ের যৌথ মালিকানায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ব্যাংকে রক্ষিত সেসময়কার ১৩০০০ টাকা বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। (সে সময়ে এক বিঘা জমির দাম ছিল ৫০ টাকা)। স্বজন ও বিপুল অঙ্কের অর্থ হারিয়ে উদ্ভ্রান্তের মত সারা ভারত ঘুরতে থাকেন। ১৯৩৮ সালে ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) এর নিম্নতম ৩০ পুরুষ , মোজাদ্দেদে জামান ও আমিরুস শরিয়ত মোহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিকি ফুরফুরাভী রহ. (দাদা হুজুর পীর কেবলা) এর সান্নিধ্যে আসার সৌভাগ্য লাভ করেন। আব্দুল খালেক খান পাঠান আবু বকর সিদ্দিকি ফুরফুরাভী (রহ.) এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। ১৯৩৯ সালে আবু বকর সিদ্দিকি ফুরফুরাভী (রহ.) মৃত্যুর পর মুফতিয়ে বাংলা-আসাম, আলহাজ্ব মাওঃ শাহ্ ছূফী আবু জাফর মোঃ অজহুদ্দিন ছিদ্দিকী আল কোরাইশি (মেজলা হুজুর) আব্দুল খালেক খান পাঠান (রঃ) কে খেলাফত প্রদান করেন এবং ফরিদপুরের সুফি সাহেব উপাধিতে ভুষিত করেন।
আব্দুল খালেক খান পাঠান (রঃ) আধ্যাত্মিকতায় মনোনিবেশ করে পাক-ভারত উপমহাদেশে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। পাক-ভারত উপমহাদেশে তিনি ফরিদপুরের সুফি সাহেব নামে পরিচিতি লাভ করেন। বাংলা ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ওয়াজ-নসিহত,আধ্যাত্মিকতা ছড়িয়ে দিতে নিজেকে বিলিয়ে দেন। পাক-ভারত উপমহাদেশে হাজার হাজার মানুষ আব্দুল খালেক খান পাঠান (রঃ) এর থেকে আধ্যাত্মিকতায় দীক্ষা লাভ করতে থাকেন। নিজগ্রাম বেজড়াতে মহিউল উলুম সিনিয়র মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাসহ শিক্ষা বিস্তারে অবদান রাখতে থাকেন।
তাছাড়া চর্মরোগের একটি মলম "ফরিদপুরের সুফি সাহেবের মলম"এতটা কার্যকর ছিল যে, যত পুরাতন চর্মরোগ হোকনা কেন, একবার ব্যবহার করলেই যেকেউ আরোগ্য লাভ করতো।
১৯৬২ সালে এ মহান সাধক ও আধ্যাত্মিক নেতা এ ধরাধাম ত্যাগ করে মহান রবের সান্নিধ্য লাভ করেন।
(এহছান খান পাঠান; বার্তা সম্পাদক, দৈনিক অর্থনীতির কাগজ ও নির্বাহী পরিচালক, আইসিটি ক্যারিয়ার)