অণুগল্পঃ ভূপেন বাবু'র হালখাতা।

 প্রকাশ: ২৩ অগাস্ট ২০২০, ০৭:৩১ অপরাহ্ন   |   সাহিত্য-সংস্কৃতি


খুলনা ব্যুরো প্রধান জিয়াউল ইসলামঃ

লেখকঃ  সুব্রত  চৌধুরী 

  ** * সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।  ভূপেন বাবু একসাথে দুটো ধূপকাঠি জ্বালিয়ে হাতে নিল, তারপর দোকান ঘরের উত্তর পাশের কোনায় সবচেয়ে উপরের তাকে রাখা গণেশ ঠাকুরের বাঁধানো ফটোর সামনে কাঠি দুটো  পাঁচ ছবার বৃত্তাকারে ঘুরালো।  এরপর  নিজস্ব ঢঙ্গে চাওয়া পাওয়া মেশানো কিছু শব্দ মনে মনে  মন্ত্রের মত  উচ্চারণ করে কাঠি দুটো গণেশের ফটোর পাশে  রাখা ধূপদানিতে গেঁথে দিয়ে হাত জোড় করে আরো কিছুক্ষণ বিড়বিড়করলো । "এই ধূপকাঠির গন্ধটা ভারি মিষ্টি, মনকে একেবারে পূতপবিত্র করে তোলে"- সন্ধ্যা বেলায় দোকানে আগত অনেকেই এমনটা বলে। ভূপেন বাবুর নিজেরও তেমনটাই মনে হয়, যেমন এই মূহুর্তে নিজেকে মন্দিরের কোন পুরুতঠাকুর বলে মনে হচ্ছে!  তবে বেশিক্ষণ পুরুতঠাকুর সাজা হলোনা তার। মনের মধ্যে আবারও হালখাতা'র ব্যাপারটা চলে এলো। শালার করোনা ভাইরাস এবার বোশেখ মাসের হালখাতাটার সাড়ে সর্বনাশ করে দিয়েছে, আমার এতগুলো টাকা বাকি পড়ে রইল, উহু চিন্তা করলেই মাথা বোঁবোঁ করে ঘোরে! "  দোকানের মাঝখানে কাঠের টুলটা'র উপর বসে সামনের রাস্তার  দিকে হতাশ দৃষ্টিতে তাকালো পঞ্চান্ন বছর বয়সী ভূপেন বাবু। মুদি দোকান দিয়েই তার সংসার চলে। দুটো মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে আর দুটোকে পড়াশোনা করাচ্ছে সবই এই পাড়াগাঁয়ের  দোকানের আয় থেকেই। কোনো-কোনো দিন থাকে খদ্দের টদ্দের তেমন একটা আসেনা আজ বোধহয় সেইদিন, যদিও করোনার ভয় আগের মত আর নেই গ্রামের মানুষ মাস্কও তেমন পরে না । কম কেনাবেচায়  ভূপেন বাবুর মন মেজাজ দুটোই খারাপ হলো। 

অনেকক্ষণ ধরে প্রসাব চেপেছে কিন্তু ওঠা হয়নি এখন দোকান থেকে নামতে যাবে এমন সময় দোকানের সামনে দাঁড়ানো বছর ত্রিশের নারীর  দিকে তাকিয়ে খুশিতে তার সামনের দিকের  সবগুলো দাঁত বেরিয়ে এলো। প্রসাব করতে আর যাওয়া হলোনা তার। 

" কিরে মীনাক্ষী,  তা কী লাগবে বল? আমার দোকান তো ভুলেই গেছিস, সেই বোশেখের প্রথমে এসেছিলি আর এখন শ্রাবণ! "

এই কথার বিপরীতে  অপর পক্ষ থেকে কোন শব্দ ভেসে এলোনা।   

এবার  মুখের হাসি লুকিয়ে খানিকটা অভিমান আর রাগ মিশিয়ে ভূপেন বাবু বলতে থাকলো-

" ও করোনার ত্রাণ বুঝি আর পাচ্ছিস না তাই আবার আমার দোকানে এসেছিস!"

  এবার গলার স্বর একেবারে নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলতে শুরু করলো ভূপেন বাবু। যেমন একটু আগে গণেশ ঠাকুরের কাছে সে দাবিদাওয়া'র শ্লোক আওড়াচ্ছিল যেন তৃতীয় আর কেউ না শোনে। -"আচ্ছা তুই আমাকে কী ভাবিস বলতো, তোর সাথে আমার কী চুক্তি ছিল? দুইশো টাকা বাকি হলেই আমি একবার তোর ওখানে যাবো, প্রায় সাতশো বাকি বুঝলি! "

অপর পক্ষ তেমনই নিশ্চুপ। 

" মীনাক্ষী দেখ তোর সাথে আমার কত মিল, তোর স্বামীটা বিছানায় পড়ে আছে আর আমার বউটাও এই ক'বছর ধরে কঠিন ব্যামো নিয়ে শয্যাশায়ী। " 

এই বার মুখ খুললো নারীটি- " ভূপেন বাবু, করোনা'র জন্য ছেলেমেয়েরা ঘর থেকে একদম বের হয়না। ক'টা দিন গেলেই আমি আপনাকে ডেকে নিয়ে যাবো আপনি যতবার যেতে চান। এখন আমাকে কিছু চাল, ডাল আর আলু দিন, আমি জোড় হাত করছি।"

মৃত মাছের চোখ দিয়ে তাকিয়ে বাষ্প কন্ঠে বললো ময়লা শাড়ির ছিপছিপে নারীটি।   

" আহা তুই এভাবে বলছিস কেন, আমার ব্যাপারটাও তো তোর বুঝতে হবে তাইনা। শোন আমি চাই তোর আমার লেনদেনটা বহু বছর ধরে চলুক আর এখন যা যা লাগে আমি সবকিছুই দিচ্ছি মীনাক্ষী তুই কিন্তু আমাকে  ডাকতে বেশি দেরি করিস না।" কথা শেষ করে ইতিউতি তাকিয়ে  নারীটির হাত চেপে ধরলো ভূপেন বাবু।